গল্পঃ ঘেমোঘরে আলোহীন
ক্যাম্পাসে যে মেসটায় আমরা থাকি সেখানে আলো বাতাসের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। থাকি
গ্রাউন্ড ফ্লোরে, সামনের অংশজুড়ে পুরোটা গ্যারেজ। সারাদিন শহর দাপিয়ে এসে গাড়িগুলো
রাতে এখানে আশ্রয় নেয়। ওদের তখন দেখলে মনে হয় লাইব্রেরীর ঘুমন্ত বই। সারাদিনের রাস্তার
কোলাহল নিজের মধ্যে জড়ো করে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে রাত্রিজুড়ে। গ্যারেজটা পেরিয়ে সামনে
গেলেই বাড়ির মূল গেট। সেদিকে তাকালে উজ্জ্বল আলো দেখা যায়, কিন্তু সে আলো গ্যারেজ পেরিয়ে
ঘরে প্রবেশ করতে পারেনা। আমার রুমে জানলার পাশে বসে সেদিকে তাকালে মনে হয় সেটা গুহার
মুখ, আর আমরা কজন গুহাবাসী। ঘরের ক্রীম কালারের দেয়ালটা যেনো গুহার দেয়াল, এখুনি বোধহয়
সেখানে আঁকতে শুরু করে দেবো গুহাচিত্র। কিন্তু আমাদের কিছুই করা হয়না-ঘরের ভেতরের অন্ধকার
আমাদের সিঁধিয়ে রাখে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ ঘরে আমাদের শরীরগুলো যেনো কোনো জড় পদার্থ, আলাদাভাবে
একে চিহ্নিত করা যায়না। যেনো ঘন কালো আঁধারের একেকটা পুটলি মটকা মেরে পড়ে থাকে রুমের
কোণে। সেখান থেকে তাকিয়ে থাকি সিলিং এর দিকে। রুমের অন্ধকার আর আমাদের ভেতরের অন্ধকার
মিলেমিশে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মতো উপরের দিকে উঠে গিয়ে সিলিংয়ে নানারকম নকশা কাটতে থাকে।
সেই নকশার ঘোরে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে পর্দাটাকে আরেকটু টেনেটুনে শেষ খোলা অংশটাও ঢেকে
দিই। এভাবে অন্ধকার আর নৈঃশব্দকে আরেকটু জোড়ালো করি। মাথার ভেতর বাজতে থাকে CAS ব্যান্ডের
Apocalypse গানের শুরুর অংশটা। ইলেকট্রিক গিটারে বাজানো মিউজিকটা একটা কেমন স্বপ্ন
স্বপ্ন আবহ তৈরী করে। চোখ বন্ধ করে অন্য একটা জগতে হারিয়ে যাই, সেখানে দূর থেকে গানের
সুর ভেসে আসছে আর আমি যেনো বিছানা থেকে উঁচুতে ভাসতে থাকি। চারদিকে গাঢ় কুয়াশাচ্ছন্ন
নীলচে আভা। গানটা রিপিটেড মোডে বাজতে থাকে। আমি অতল গভীরে হারিয়ে যাই। আধো ঘুম, আধো
জাগরণে অনেকটা সময় কেটে যায়। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে আসে। আমাদের জীবন থেকে ব্রেকফাস্ট
হারিয়ে গেছে বহুদিন হলো। দুপুর হয়ে আসলে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা টুংটাং শব্দে বুঝতে
পারি খাবার খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের
দিন শুরু করি। আমাদের ঘরের দরজা পেরুলে ড্রইং আর ডাইনিং স্পেস। দুটো পুরোনো টেবিল সেখানে
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আজ বহুদিন হলো। মেসের প্রতিটা সদস্য বাসায় প্রবেশের সময় কিছু নিজস্ব
আসবাব নিয়ে প্রবেশ করে, আর প্রস্থানের সময় কিছু পুরোনো আসবাব ফেলে যায়। টেবিল গুলো
সেভাবেই এই মেসে রয়ে গিয়েছে। আমি এই মেসে আসার আগে থেকেই এরা ছিলো, আমি চলে যাবার পরেও
এরা থেকে যাবে। ডাইনিং পেরিয়ে সামনে গেলে আরো দুটো ঘর, প্রতি ঘরে দুজন করে থাকে। এই
ছয়জন মিলেই আমাদের মেস। সবাই নিজ নিজ ঘরেই কাটিয়ে দেই সিংহভাগ সময়। মাঝেমধ্যে কচ্ছপের
মতো খোলস থেকে মাথাটা বের করে একে ওপরের ঘরে গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলি- এরপর আবারো মাথা
ঢুকিয়ে নেই ভেতরে। ভার্সিটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি, ক্লাস এখন হয়না বললেই চলে।
তাই বাইরে বেরোবার প্রয়োজনও খুব একটা হয়না। বাইরের পৃথিবীটা বড্ড রূঢ়, তারচে ভেতরের
কোমল অন্ধকারটাকে বেশি আরামদায়ক মনে হয়। তবে ঘরেও করবার মতো বিশেষ কিছু থাকেনা- বড্ড
আয়োজনহীন, উদ্দীপনাহীন জীবন। তাই ঘরের ভেতরের এই গ্লুমি আবহাওয়াকে কম্বলের মতো শরীরের
সাথে মিশিয়ে দিনের পর দিন পার করে দেই।
রুটিন ঘেরা এই জীবনে একদিন এক ব্যতিক্রম
হলো। সেদিন সকালে হঠাৎ করে চোখে লাইটের আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখলাম
আমার রুমমেট তন্ময় বসে আছে ওর পড়ার টেবিলে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই জানালো ঘরে বিড়াল
এসেছিলো, তার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেছে ওর। পরে বিছানা ছেড়ে নাস্তা করলো আর বিড়ালটাকেও
বিস্কুট দিলো। রুমের কোণে তাকিয়ে আমি বিস্কুটের গুড়ো পরে থাকতে দেখলাম। মনে পড়লো, দুদিন
আগে সকালে আমার খাটের তলা থেকে স্যুটকেস বের করতে গিয়ে একটা বিড়ালকে আবিষ্কার করি।
একটা বিস্কুটের কার্টন বক্সের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে জ্বলজ্বল করে খানিকক্ষণ চেয়ে
ছিলো। এরপর সেটা উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে যায়। তন্ময়ের কথা শুনে বুঝলাম সে বিড়ালটিই
আজ ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। আমি বিছানায় উঠে বসে জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। বাইরের
উজ্জ্বল আলো যেনো রাস্তাটাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সে আলো গায়ে মেখে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে,
ফেরিওয়ালা ভ্যানে করে সবজি বা মাছ নিয়ে ঘুরছে। রিকশায় করে অফিসগামী লোকেরা ছুটে যাচ্ছে।
সবার মধ্যেই একধরণের চঞ্চলতা। অন্ধকার ঘরে বসে ঘুম ভাঙা চোখে সেসব দেখতে দেখতে নিজেকে
টিভির সামনে বসে থাকা একজন দর্শক মনে হচ্ছিলো। টিভি পর্দার ওই মানুষগুলো অন্য জগতের,
ওদের সাথে আমার কোনো সংযোগ নেই। হেমন্তের একটা গান মনে পড়লো ‘আমার চতুর্পাশে সবকিছু
যায় আসে, আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা…।’ এই গান গুণগুণ করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠলাম।
র্যাক থেকে চা পাতা আর চিনির কৌটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম। চা বসিয়ে দিয়ে এসে
নিজের টেবিলের দিকে চেয়ে রইলাম। অগোছালো টেবিলে বই, খাতা, কলম আর ধূলোর স্তর ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে। একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে টেবিলটা আলতো করে পরিষ্কার করলাম, বই খাতা গোছগাছ
করলাম। এরপর চা নিয়ে এসে টেবিলের সামনের চেয়ারে বসলাম। জিহ্ববা চায়ের প্রথম স্পর্শ
পেতেই সমগ্র শরীরে এক উচ্ছল উদ্দীপনা ছড়িয়ে গেলো। মোবাইলটা নিয়ে একটা একটা গজল ছেড়ে
দিলাম। “রানজিশ হি সাহি, দিল হি দুখানে, কে লিয়ে আ…/ আ ফির সে মুঝে ছোড় কে জানে
কে লিয়ে আ …” । মেহেদি হাসানের গলায় এ গজল শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় সমগ্র
হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠলো। অনেকদিন পর এত সকালে ঘুম থেকে ওঠায় আজকের দিনটাকে স্পেশাল কিছু
মনে হতে লাগলো। সকালবেলাটা অতটাও খারাপ না, নিজের মনে বলে উঠলাম। চা শেষ করে
একটা বই নিয়ে বসে পড়লাম। মুজতবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’। ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়রের কাছ
থেকে বইটা নিয়ে এসেছিলাম। মুজতবা আলীর হিউমার সবসময়ই আমার কাছে ভারী উপভোগ্য। অনেকক্ষণ
বইটা নিয়ে পড়ে রইলাম। পড়তে পড়তে প্রায় দুপুর হয়ে এলো, মেসে স্বভাবগত চঞ্চলতা ফিরে এলো।
এরপরের দিন থেকে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হতে লাগলো। বিড়ালটা নিয়মিত আমাদের ঘরে
আসতে লাগলো, আমরা নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে উঠতে লাগলাম। সকাল সকাল থেকে ঘুম থেকে ওঠায়
দিনটাকে অনেক বড় মনে হতো। আমাদের জীবনের এই অতিরিক্ত সময়টাকে কাজে লাগানোর ভিন্ন ভিন্ন
উপায় খুঁজে নিলাম আমরা। আমাদের জীবনে ব্রেকফাস্টও ফিরে এলো। তন্ময় টোস্ট বিস্কুটের
সাথে চা খেতে খেতে ফুটবল ম্যাচের এনালাইসিস ভিডিও দেখতো, আর আমি কখনো বই আবার কখনো
রিসার্চ পেপার পড়তাম। মাঝেমধ্যে আমি আর তন্ময় সকালে হাঁটতে বের হতাম। আমাদের পাশ কেটে
ছুটে যেতো ব্যস্ত সব মানুষেরা, তার মাঝে আমরা জীবনের গল্প করতাম। তন্ময় বলতো পরিবারের
কথা, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা আর আমি বলতাম আমার নিজের পৃথিবী আর বাস্তব পৃথিবীর মধ্যকার
পার্থক্যের কথা। তবে আমাদের সব কথার শেষ হতো হাসি-ঠাট্টা দিয়ে। এরপর আমরা বাসায় ফিরে
যথারীতি নিজ নিজ ভুবনে ডুব দিতাম।
একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি আমার খাটের নিচের বেড়ালটা
সেখানে একজস্টিং ফ্যানের ফাকা জায়গা দিয়ে উকি মারছে। আমাকে দেখেই ম্যাঁও ম্যাঁও করে উঠলো। প্লেট থেকে কিছু কাটা
নিয়ে রান্নাঘরের উপরের তাক টায় ছুড়ে দিলাম। বেড়াল সেখানে এসে সেগুলো চিবুতে শুরু করলো।
পরের দিন থেকে রান্নাঘরের ঐ তাকটায় কাটার সাথে সাথে কিছু মাছের অংশও জমা হতে লাগলো।
কখনো আমাদের সামনে, কখনো অজান্তে বিড়াল এসে সেগুলো খেয়ে যায়। একদিন উপরের ঐ উঁচু তাকটায়
উঁকি দিয়ে দেখলাম অনেকগুলো শুকনো কাটা সেখানে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। বুঝলাম, আমিই এই মেসে
বেড়ালটার একমাত্র খাদ্য সরবরাহকারী নই। তবে উলটো টাও ঘটলো, বিড়ালটার অবাধ বিচরণ মেসে
কারো কারো আপত্তির কারণ হয়ে দাড়ালো। পরবর্তী মেস মিটিং এ আরো অনেক কিছুর সাথে বিড়ালের
প্রসঙ্গ টাও উঠলো। এই মেস মিটিং টাকে আমার কাছে মনে হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের
অধিবেশন। সেখানে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। মেসের তুলনামূলক নতুন সদস্যরা হলো সাধারন
সদস্য রাষ্ট্রের মতো। আর পুরোনোরা যেনো নিরাপত্তা পরিষদের টপ ফাইভ- তাদের সিদ্ধান্তে
বা ভেটোতে প্রস্তাব বাতিল বা গৃহীত হতো। আমার নিজেকে মনে হয় চীন- যখন প্রথম এ মেসে
পা রেখেছিলাম তখন ছিলাম একদম নাদান শিশু, একশ বছর আগেকার চীনের মতো। এখন মেসের দ্বিতীয়
জৈষ্ঠ্য সদস্য, আমেরিকার পরেই অবস্থান। বিড়াল নিয়ে মিটিং এ নিম্নলিখিত আলোচনা হলো-
সদস্য ১। ভাই, বিড়ালটা তো প্রায়ই ডিস্টার্ব করতেসে। কী করা যায়?
সদস্য ২। এটা কোন দিক দিয়ে আসে?
সদস্য ৩। রান্নাঘরের উপরের একজস্টিং ফ্যানের ফাঁকা অংশ দিয়ে।
সদস্য ২। তাহলে ঐ জায়গাটা আটকে দিতে হবে।
আমেরিকা ও তার মিত্ররা চীনের সমুদ্রপথ আটকে দিতে চাইছে
আমি। কিন্তু সেক্ষেত্রে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বিড়াল ঢুকতে পারবে।
সদস্য ১। তাহলে জানলাগুলোও বন্ধ রাখতে হবে।
আমি। রান্নাঘরের ধোয়ায় পুরো ঘর ভরে যাবে।
তন্ময়। আবার গ্যাস লিক হলে পু্রো ঘরে আগুন লেগে যাবে।
পথ সুগম রাখার জন্য চীন, রাশিয়ার যৌথ প্রচেষ্ঠা
সদস্য ২। তাহলে কী করা যায়?
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কিছুই করার দরকার নেই। বিড়াল নিজের মতো
কাটা খেয়ে চলে যাবে। তাছাড়া বিড়াল পালা সুন্নত। মাঝেমধ্যে খাবার টাবার দেওয়া ভালো।
রিলিজিয়াস ট্রাম্প কার্ড।
এরপর থেকে বিড়ালের আসা-যাওয়া নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি করলো না। বিড়ালটা দুপুরে একবার,
সন্ধ্যায় একবার আসে। নিজে খাবার খুঁজে নেয় আর আমাদের কাছে খোঁজে আদর। ওর উপস্থিতি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো।
কখনো জানলা দিয়ে, কখনো রান্নাঘর দিয়ে চলে আসে ঘরের ভেতর- অন্য কোনো রুম নয়; সোজা আমাদের
রুমেই চলে আসে। তন্ময় তার সকালের নাস্তার টাকা বাঁচিয়ে কেনা ৪০ টাকা দামের শখের ওয়েফারের
একটা অংশ ভেঙে বিড়ালটাকে দেয়, সে খুশিমনে খায়। ওর খাওয়া দেখতে ভাল্লাগে আমাদের। আমিও
আমার এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট থেকে বিস্কুট দেই, কিন্তু তাতে ও মুখ দেয়না। ‘এটা মনে
হয় উঁচু বংশের বিড়াল’, তন্ময় হেসে বলে। ‘ব্রাহ্মণ’, আমি বলি। ‘আর আমরা দলিত’। আমরা
একসাথে হেসে উঠি। বিড়াল খেয়েদেয়ে আমাদের আদর নিয়ে চলে যায়। আমরা নিজ নিজ প্রোডাক্টিভ
হবার মিশনে ডুব দেই।
এর কিছুদিন পর বিড়ালটাকে আগের মতো দেখতে পেলাম না। আমাদের তখন পরীক্ষা চলছে। এ
নিয়ে খুব বেশি ভাবনার অবসরও নেই। মাঝেমধ্যে জানলা দিয়ে যথাসম্ভব মাথা ঠেলে দিয়ে এপাশ-ওপাশ
খুঁজি, বিড়ালের টিকি টাও দেখা মেলে না। এরপর আবার পড়তে বসি। দু তিনদিন পরের কথা। সেদিন
সকালে ঘুম থেকে উঠে র্যাকের নিচের তাক থেকে ল্যাপটপটা নেবার জন্য নিচু হয়েছি, হঠাৎ
খাটের নিচে প্রাণের উপস্থিতি টের পেলাম। বিড়ালটা বসে আছে, একটা বিস্কুটের কার্টন বক্সে।
‘কিরে কী খবর?’ জিজ্ঞেস করেই বিড়ালের আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলাম। অন্যসময়
হলে বের হয়ে আসতো, কিন্তু এবার আরেকটু আঁটোসাঁটো হয়ে বসে রইলো। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে
উঁকি মেরে থ মেরে গেলাম। প্রাণের স্পন্দন আছে বটে, তবে একটা নয়- একাধিক প্রাণ। বাচ্চা!
বিড়াল মৃদুস্বরে ‘ম্যাঁও’ করলো, যেনো খানিকটা বিব্রত। ভালোমতো খেয়াল করে দেখলাম তিনটা বাচ্চা নিয়ে বিড়ালটা
সতর্ক ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। আমি ওদের অভয় দেবার জন্য সড়ে এলাম। এমতাবস্থায় আমার কী করণীয়
তা ভাবতে ভাবতে খানিকক্ষণ পায়চারি করলাম, এরপর আপাতত ওদেরকে ওদের মতো থাকার অবকাশ দিয়ে
পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। পরীক্ষার পর বাইরে বের হয়ে তন্ময়কে জানালাম, ধীরে
ধীরে মেসের প্রত্যেকেই জানলো। সন্ধ্যায় সবাই এসে উঁকি দিয়ে সদ্যোজাত ছানাগুলোকে দেখে
যেতে লাগলো। বিড়াল ও তার শাবক নিয়ে নানা স্মৃতিকথা ও ডিসকাসন হতে লাগলো। আমাদের রুমটা
হয়ে উঠলো একটা মিউজিয়াম, আর আমার খাটের নিচটা হয়ে উঠলো আর্ট গ্যালারী। নিজেকে আমার
বেশ স্পেশাল মনে হতে লাগলো। আমার খাটের নিচেই তো বাচ্চা দিলো! , ভাবি আমি। তিনটা
ছোট ছোট ছানা- একটা কালো, একটা সাদা আরেকটা মায়ের মতো সোনালী আর অল্প সাদা-কালোর মিশেল।
বিস্কুটের বাক্সটায় এরা জড়োসড়ো হয়ে মায়ের শরীরের মধ্যে ডুবে থাকে, খিদে পেলে মাঝেমধ্যে
চি চি করে ডাকে। আমি নিচু হয়ে বসে ওদের দেখতে থাকি। রাতে ঘুমানোর সময় যেনো ওদের নিঃশ্বাসের
শব্দ শুনতে পাই। আমার খাটের নিচে একটা ছোট্ট বাক্সে তিনটা প্রাণ বেড়ে উঠছে- ভাবতেই
বড় রোমাঞ্চ জাগে মনে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবার প্রথমে
ওদের গুড মর্নিং জানালাম। খাটের নিচটায় ঝাড়ু পড়েনা বহুদিন। দেবার প্রয়োজনও বোধ করিনি
এতদিন। কিন্তু ‘আজি এ পরাণে রবির কর’ আমাকে ব্যস্ত করে তুললো। খাটের নিচটায় আলতো করে
ঝাড়ু দিলাম, মা বিড়াল তাকিয়ে তাকিয়ে আমার কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। পাউরুটি
দিয়ে নাস্তা করলাম, বিড়ালকে সাধলাম, সে গন্ধ শুকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিড়াল দুপুরের দিকে
একবার খাটের নিচ থেকে বের হলো, আমার পায়ের সাথে শরীর ঘসতে লাগলো। ওর শরীরে হাত বুলিয়ে
দিলে চোখ বন্ধ করে আদর নেয়। আমি ডাইনিং রুমে গেলাম ওকে খাবার দেওয়ার উদ্দেশ্যে, সাথে
সাথে বিড়ালটাও এলো। ওর ডাক শুনে পাশের রুম থেকে আসিফ ভাই চলে এলেন। ‘কীরে কি অবস্থা?’,
বিড়ালের উদ্দেশ্যে বললেন তিনি। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী করছি।
‘এটাকে কী খাইতে দেওয়া যায় ভাবতেসি’
‘এটাকে ঘরের ভিতর খাওয়ার অভ্যাস করাইয়ো না, পরে পার্মানেন্টলি ঘরে থেকে যাবে।’
এই কথা শুনে আমি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং রুমে
‘এই নে, ছু ছু, খা খা’ টাইপ শব্দ শুনে যেয়ে দেখলাম আসিফ ভাই একটা সাদা বাটিতে তরকারি
দিয়ে ভাত মেখে বিড়ালকে খাবারের জন্য ডাকছেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রুমে
ফিরে লুই আর্মস্ট্রং এর গান শুনতে লাগলাম, “..And I think to myself, What a
wonderful world !”
বিড়াল ও আমাদের জীবন পাশাপাশি সমান্তরাল রেখায় চলতে লাগলো। সকাল সকাল ঘুম থেকে
উঠে বিড়ালটাকে ‘ম্যাঁও’ বলি, বাচ্চাগুলো কতটুকু বড় হলো তা দেখি। খানিক পরে তন্ময় ঘুম থেকে উঠে বিড়ালকে
ডাক দেয়, বিড়াল এক লাফে ওর খাটে উঠে যায়। বিড়ালটা সাধারণত অন্য কারো খাটে কখনো ওঠে
না, এমনকি তন্ময়ের খাটেও না। কেবল ও ডাক দিলেই উঠে আসে। ‘বিড়ালটার ম্যানার দেখছিস?’
তন্ময় বলে। ‘ছোটবেলা থেকে এত বিড়াল দেখলাম, কিন্তু এত লক্ষী আর কাউকে পাই নাই।’ ‘আমিও
না’, সহমত জ্ঞাপন করি আমি। ‘এটা আসলে বিড়াল না। কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলো নিশ্চয়ই,
কোনো দেবতা অভিশাপ দিয়ে বিড়াল বানায় দিসে। ঐ যে পৌরণিক কাহিনীর মতো’, তন্ময় বলে। ‘হ্যাঁ,
দেবতা জিউস। শালা নারীলোভী ছিলো। হয়তো প্রেমের প্রস্তাব দিসিলো, এক্সেপ্ট করে নাই’,
আমি যোগ করি। ‘হইতে পারে’, তন্ময় গম্ভীরমুখে বললো। ‘কিন্তু জিউসকে ফিরায় দিলো কেন?’
‘কারণ ওর মন তোরে দিয়ে রাখসিলো। এজন্য এখন শুধু তোর বিছানায় উঠে যায়।’ আমরা দুজনে উচ্চস্বরে
হাসতে থাকি। হাসির শব্দে পাশের রুম থেকে সিনিয়র ভাইয়েরা চলে আসে। তারাও বিড়াল সংক্রান্ত
আড্ডায় যুক্ত হয়। কেউ বলে তার মায়ের পছন্দের এক বিড়াল হারিয়ে যাবার কষ্টের গল্প, আবার
কেউ বলে কালোবিড়াল সংক্রান্ত লোকবিশ্বাস। এসবের মাঝে আমাদের বিড়ালটা খাটের মধ্যে গা
মিশিয়ে শুয়ে থাকে। দেখতে বড্ড মায়া লাগে!
এভাবে একদিন একদিন করে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। অক্টোবরের প্রারম্ভিক গরম কেটে
গিয়ে শীতের প্রথম স্পর্শ শরীরে দোলা দিতে লাগলো। আমাদের দীর্ঘ বরফশীতল এক্সাম শেষ হয়ে
এলো, মুরাকামি আরেকবার নোবেল প্রাইজ মিস করলো, একাকী বিকেলগুলো আমাকে ঘনঘন বিষন্নতায়
ডুবিয়ে দিতে থাকলো। তবে সেসব ছিলো কেবল শীতের শুরু। শীত সবসময়ই দীর্ঘ হয়, এবং ভালোলাগার
মুহূর্তগুলো হয় ক্ষণস্থায়ী। তাই কেউ যত আগ্রহ নিয়েই শীতের অপেক্ষা করুক না কেনো, শীত
সুদিন নিয়ে আসেনা। শীত নিয়ে আসে কুয়াশার জাল। শীত নিয়ে আসে আশা, ভালোবাসা আর দিয়ে যায়
বিষাদ। তেমনই এক শীতের সকালে যথারীতি আমি ঘুম থেকে উঠে স্বভাবের বশে খাটের নিচে উঁকি
দিলাম, দেখলাম বাক্সটা খালি। আমি চোখ কচলে আবারো তাকালাম, বাক্সটা সত্যিই খালি। ক্ষীণ
আশা নিয়ে লাইট নিয়ে খাটের নিচের বাকি অংশগুলোতেও খুঁজলাম, কোথাও কেউ নেই- না বাচ্চাগুলো,
না মা বিড়াল। বিড়ালেরা বাচ্চা দেবার পর তিনবার জায়গা বদল করে। কদিন আগে বলেছিলো
আমার এক বন্ধু। আমি খাটে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর তন্ময় সহ বাকিরাও জানতে পারলো বিড়ালের
প্রস্থানের খবর। এটা একটা স্বাভাবিক প্রসেস, বিড়ালেরা এভাবেই বড় হয়, এভাবেই ওরা
টিকে থাকে। এটাই ছিলো সব কথাবার্তার সারমর্ম। আমি বিড়াল ও ওর বাচ্চাগুলোর মঙ্গল
কামনা করে খাটের নিচ থেকে বাক্সটা বের করে আনলাম, তখনো এর মধ্যে যেনো ওদের শরীরের উত্তাপ
লেগে ছিলো। বাক্সটা বাইরে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। এরপর ঘরে ফিরে করার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে আবার রুমের বাতি নিভিয়ে
শুয়ে পড়লাম। ব্রেকফাস্ট করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। বাইরের আলোটাকে অসহ্য বোধ হওয়ায়
জানলার পর্দাটা টেনে দিলাম। ঘরের মধ্যে সেই বিখ্যাত অন্ধকার ফিরে এলো বহুদিন পর। কাঁথা
টাকে কাছে টেনে নিলাম। মোবাইলটা থেকে র্যান্ডমলি একটা গান ছেড়ে দিলাম, Somewhere only
we know বাজতে শুরু করলো।
‘Oh, simple thing, where have you gone?
I'm getting old, and I need something to rely on
So, tell me when you're gonna let me in
I'm getting tired, and I need somewhere to begin’
আমি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে গান শুনছিলাম। হঠাৎ দেখলাম উপরে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মতো
কিছু একটা নকশা কেটে যাচ্ছে। এদের এতদিন দেখিনি কেনো? ভাবলাম আমি। এরা এতদিন কোথায় ছিলো? অথবা, হয়তো ছিলো;
আমিই লক্ষ করিনি। তন্দ্রায় আমার চোখ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তলিয়ে যেতে থাকি গভীরে। ঘুমানোর
আগে শেষবারের মতো শুনতে পাই, ‘I'm getting old, and I need something to rely on.’

You write so good! Apocalypse my favorite song too... very nostalgic and tasteful writing!
ReplyDeleteThanks apu!!!
Delete